ম্যানিলার তীব্র গরমের আরো একটি দিনে কেভিন তার মোবাইল মুছে ফেইসবুক গেমিং ঘাটাঘাটি করছে। একটু আড়মোড়া দিয়ে প্লে দ্যাট ফাংকি মিউজিক গানটা ছেড়ে আরো এক রাউন্ড গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রিমিং করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো ৫ ঘন্টার জন্য।
চলুন পরিচিত হই কেভিন আলেক্সিস বোর্হা মাগলাকীর সাথে, ২৪ বছর বয়সী একজন স্নাতক উদ্যোক্তা, যার পছন্দ হুপস্ খেলা, ভলিবল মারা, আর নেটফ্লিক্স দেখা। সে খুব সাধারণ একজন মানুষ, কিন্তু করছেন কিছু অসাধারণ কাজ, শুধু সে তার ডান হাত আর বাম পা দিয়েই মূলত সব কাজ করে থাকে, এটা বাদে। কেভিন জন্ম নিয়েছিল বাম হাত ছাড়াই, ডান হাতটিও পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করেনি (মাত্র ৩টি আঙ্গুল) সেটিও বাঁকা করার ক্ষমতা নেই।
আজকের গল্পটি এক হাত এ খেলা এই গেমিং কিংবদন্তি কে নিয়েই।
গেমিং এর শুরু
কেভিন প্রথম কাউন্টার স্ট্রাইক খেলে ২০০৮ সালে যখন সে গ্রেড স্কুল এ পড়ে। তাকে সুবিধার জন্য নিজের মতো কিছু সমন্বয় করে নিতে হয়েছিল; কেভিন দক্ষতার সাথে তার বাম পা দিয়ে কিবোর্ড এবং তার ডান হাত দিয়ে মাউস চালায়। তার আশপাশের সবাইকে সে চমকিয়ে দেয় এবং তাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেয়।
“আইহাই! এটা কিভাবে করলে?!”
” আসলেই? এটা কিভাবে সম্ভব? সে কিভাবে খেলতে পারে?”
“সত্যি বলতে ভেবেছিলাম তুমি একটি সহজ শিকার হবে। কিন্তু তুমি অনেক দারুণ খেলো অন্যদের চেয়ে।”
“ধুর ছাই, তুমি ভালো খেলো। কিন্তু তোমার *** হারিয়েছি, হাহা!”
মানুষ দ্রুতই বুঝতে পারলো কেভিন বেশ প্রতিজ্ঞ গেমিং এর ব্যাপারে। কেভিন কম্পিউটার এর দোকান থেকে অন্যান্য গেমস যেমন – কল অফ ডিউটি, এনবিএ ২কে , ডটা ১ & ২, এমনকি জিটিএ গেমস এ পারদর্শী হতে লাগলো। কেভিন পিসি গেমিং থেকে মোবাইল গেমিং এ খেলা শুরু করে এবং মোবাইল লিজেন্ডস, পিইউবিজি মোবাইল এবং তার নিজস্ব পছন্দ কল অফ ডিউটি মোবাইল খেলা শুরু করে। ।
খারাপ ইন্টারনেট সংযোগ এর আশীর্বাদ
কেভিন বরাবরই বড় কোনো কিছু করার জন্য মুখিয়ে ছিল। কেভিন এর কালজয়ী মুহূর্ত এলো যখন তার এক বন্ধু স্ট্রিম সিটি চালু করতে চেয়েছিলো কিন্তু খারাপ ইন্টারনেট সংযোগ এর জন্য করতে পারছিলো না। কেভিন নিজেই একটা স্ট্রিমিং পেজ খুলে ফেলে যেহেতু তার ইন্টারনেট সংযোগ বেশ ভালো ছিল। কিছুদিন যাওয়ার পর কেভিন দেখলো সে অনেক মানুষকেই প্রভাবিত করেছে। কেউ বুঝে উঠার আগেই কেভিন বেশ পরিচিত কয়েকজন সফল স্ট্রিমার এর নজরে আসে।
এন্টার বিলিংক গেমিং, যেটা ওই অঞ্চল এ ড্যাডি বিলিংক নাম এ সুপরিচিত। কেভিন সচরাচর তার লাইভ স্ট্রিম দেখে এবং একদিন সে তার স্ট্রিম একটি কমেন্ট করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কমেন্টটি ছিল “আমি কড-এম খেলি এক হাতে এবং এক পা-এ!”
এই কমেন্টটা ছিল একটা জাদুর মতো যেটা কেভিন কে রাতারাতি খ্যাতি এনে দেয়। ড্যাডি বিলিংক কেভিন এর খেলায় এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে তিনি কেভিন এর স্ট্রিম এ শতশত ভিউয়ার নিয়ে হাজির হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবেই স্ট্রিমাররা একজন আরেকজনকে সহায়তা করে নতুন স্ট্রিমারদের জায়গা করে নেয়ার সুযোগ দেয়। এই অসাধারণ উদ্যোগ কেভিনকে স্ট্রিমিং এ মনোযোগী করে তুলে এবং এইকাজ এই সম্পূর্ণ সময় দিয়ে কাজ করা শুরু করে।
অনেকেই জানতে চায় কেভিন এর খেলা সবচেয়ে সহজ আর সবচেয়ে কঠিন গেম কোনটা।
“সত্যি বলতে কি, আমার কাছে সহজ বলে কোনো খেলা নাই, আমি গেম খেলি নিজের সর্বোচ্চ সামর্থ অনুযায়ী আর দেখতে চাই কতদূর যেতে পারি।”
কল অফ ডিউটি ওয়ারজোন সবচেয়ে কঠিন।
“যদি শত্রুর হাতে শটগান থাকে, তাহলে তাকে সামলানো কঠিন হয়ে যায়। অনেক বিশৃঙ্খলা থাকে তাই ভালো করে শট নিতে পাড়াটা ভাগ্যের ব্যাপার।”
ওয়ান হ্যান্ড গোল
ওয়ান হ্যান্ড গেমিং একটি সাধাসিধে মানুষের গল্প। কেভিন এর পরিবার তাকে অনেক সহায়তা করেছে তার এই অনুপ্রেরণামূলক উত্থানে। তার এক আত্মীয়া তাকে ল্যাপটপ ধার দেয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য ভাই বোনেরা আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র সেট করে দিয়ে সহায়তা করে, তার পরিবারের লোকেরা প্রযুক্তিগত অসুবিধা ঠিক করে দিত। সাইবার জগতে কেভিন এর উত্থান বেশ প্রশংসনীয়।
“আমার ওয়ান হ্যান্ড গেমিং এর মুখ্য উদ্দেশ্য হলো মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয়া, বিশেষ করে আমার মতো যাদের অক্ষমতা রয়েছে। আমি আমাদের মতো মানুষের প্রতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে চাই । আমি চাই তারা আমাদেরকে তাদের সমতুল্য ভাবুক দয়ার পাত্র হিসেবে নয়। আমি আমার স্ট্রিমারদের বিনোদন দিতে চাই, যেটা নিয়ে আমি অনেক কাজ করে যাচ্ছি।
এক নতুন চ্যালেঞ্জ এর অপেক্ষায়
কেভিন স্বীকার করে যে সে এখনো তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে নাই। সে দিনে কমপক্ষে ২টা স্ট্রিম করে যার একেকটি ৪-৫ ঘন্টার। কেভিন এর করা সবচেয়ে দীর্ঘ সময় এর স্ট্রিম ছিল ১০ ঘন্টার একটি হুপিং ম্যারাথন । (কে ১০ ঘন্টার ম্যারাথন করে ভারতীয় চেয়ারে বসে?)
টানা বসে থাকায় যাতে শরীরে টান না পরে এইজন্য কেভিন ঘনঘন স্ট্রেচিং বিরতি নেয় যাতে দেহের পেশীগুলো সতেজ থাকে। নিজের দক্ষতা এবং গেমিং জ্ঞানকে আরো শাণিত করতে কেভিন ঘনঘন ইউটিউবে গেমিং এর শিক্ষণীয় ভিডিও দেখে থাকেন।
ওয়ান হ্যান্ড গেমিং এর পথচলায় বেশ কিছু বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে। স্বীকার করতে হয় সরঞ্জাম সংগ্রহ একটি বড় কাজ। কেভিন একটা কম ক্ষমতাসমন্ন কম্পিউটার ব্যবহার করে আসছে, যেটা যেকোনো মুহূর্তে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আরেকটি কাজ হল স্ট্রিম দর্শকদের কাছে কিভাবে আকর্ষনীয় করা যায়। এজন্য কেভিন মজার মজার অনুপ্রেরণামূলক উক্তি ব্যবহার করে (হুগত এর উক্তি) যাতে এই প্রজন্মের স্ট্রিমাররা মজা পায়। কেভিন অনেক সময় তার শ্রোতাদের মজা করে “পাআআআওয়ার” বলে ডাকে (টাগালগ ভাষায় পা বুঝায়)। জিনিসটা আরো জনপ্রিয় হয়েছে একজন নামকরা ফিলিপিনো ইউটিউবার/ স্ট্রিমার/ভ্লগার, কং টিভি এর মাধ্যমে (এটাও তার স্বপ্নের সহযোগিতায়)।
অর্ধেক বছরের মধ্যেই, ওয়ান হ্যান্ড গেমিং ৪০০০ এর মতো ফলোয়ার পেয়ে যায় ফেইসবুকে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার ফলোয়ার এর চেয়ে ব্যক্তি কেভিন এবং তার উঠে আসার গল্পই বেশি প্রশংসনীয়।
মাত্র কিছুদিন আগেই কেভিন ও তার পরিবার একটি ফান্ড কালেকশন ইভেন্ট গঠন করে যেটায়, যারা সম্প্রতি টাইফুন এ সহায় সম্বল হারিয়েছে এবং কয়েকটি মূল শহর ডুবে গিয়েছে। কেভিন তার স্ট্রিম “স্ট্রিম করার কারন” এর সহায়তায় অনেক সাহায্য পেয়েছে যেটা দিয়ে ৬০০ প্যাকেট খাবার সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে উদ্ধারকৃতদের মধ্যে। এই কাজ এর মাধ্যমে কেভিন অভিনব এক অভিজ্ঞতা পেয়েছে যেটা সে বার বার করতে চায়।
ওয়ান হ্যান্ড গেমিং একটি দারুণ সৃষ্টি যেখান থেকে আমরা নিজেকে বিশ্বাস করার এক দৃষ্টান্ত পাই। তার কথা বলতে যেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তা নিক ভুজিচিক বলেন, কেভিন এক সাধারণ মানুষ যে কিছু অসাধারণ কাজ করছে। সে একজন মানুষের শারীরিক অদক্ষতার মাঝেও আসল দক্ষতা দেখতে পারে- তাই চালিয়ে যাও, লে ডাউন দ্যাট বুগি এন্ড প্লে দ্যাট ফাংকি মিউজিক!
স্বপ্ন দেখতে থাকো, খেলতে থাকো।